বাংলাদেশ টাইমস্
“মাসুদ সাগর “
এক যুগ বা তারও বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে বেশ কিছু আলোচিত হত্যা মামলা। যেগুলোর তদন্ত শেষ হচ্ছে না। অভিযোগ আছে, গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে না জড়িতদের। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলাসহ এসব চাঞ্চল্যকর হত্যার তদন্ত পুনরায় শুরু হচ্ছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব মামলার তদন্ত ও বিচার কাজ শেষ করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
গত বুধবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যেও এর ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বক্তব্যে বলেন, সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড বহুল আলোচিত পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তির জন্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বছরের পর বছর ঝুলে থাকা আলোচিত হত্যাগুলোর পেছনে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। যে কারণে এসব মামলায় আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। আগের তদন্তও হয়েছে লোক দেখানো। যে কারণে প্রকৃত আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বে আসার পর নিষ্পত্তি না হওয়া চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর তালিকা করা হচ্ছে। আসামি বা ভুক্তভোগী কে কোন দলের, তা বিবেচনা না করে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দ্রুততম সময়ে এসব মামলার তদন্তকাজ শেষ করতে সংশ্লিষ্টদের পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সচল হয়েছে ত্বকী হত্যার তদন্ত: নারায়ণগঞ্জে আলোচিত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমানের গাড়িচালক জামশেদসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রিমান্ডে এনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
গত বুধবার ভোরে ঢাকার মিরপুর এলাকা থেকে জামশেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ত্বকীর লাশ তার গাড়িতে বহন করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলা হয়। এর আগে ত্বকী হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সাফায়েত হোসেন শিপন, মামুন মিয়া ও কাজল হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১১। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের প্রত্যেকেই ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকেলে নারায়ণগঞ্জের শায়েস্তা খান রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে স্থানীয় সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন ত্বকী। ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী খাল থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ত্বকীর বাবা বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বী।
র্যাব-১১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা কালবেলাকে বলেন, এর আগে গ্রেপ্তার আসামিদের জবানবন্দি ও তদন্তে এবার গ্রেপ্তার চারজনের নাম এসেছিল। আমরা তাদের নজরদারিতে রেখে ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করেছি। এখন রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
মামলাটির তদন্তকাজ ৭০ ভাগ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন র্যাবের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি আগামী ৩-৪ মাসের মধ্যে মামলাটি তদন্ত শেষ করতে পারব।
১১০ বার পেছানোর পরও জমা হয়নি সাগর-রুনির তদন্ত:
১১০ বার পেছানোর পরও সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ করতে পারেনি র্যাব। পুনরায় সময় নিয়েছে তারা। একযুগ আগে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় এই সাংবাদিক দম্পতি নৃশংসভাবে খুন হন। সাগর মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক ছিলেন। রুনি ছিলেন এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক।
এ হত্যার ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। প্রথমে এই মামলা তদন্ত করছিল শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। চার দিন পর মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়।
তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিনের মাথায় ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালত র্যাবকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। তখন থেকে মামলাটির তদন্ত করছে র্যাব। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে দুজন জামিনে, বাকি ছয়জন কারাগারে আছেন।
তনু হত্যার আট বছর, পাঁচবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন, শনাক্ত হয়নি কোনো আসামি:
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যার আট বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো আসামি শনাক্ত হয়নি। থানা থেকে ডিবি, তারপর সিআইডি, সবশেষ পিবিআই মামলাটি তদন্ত করছে। এই সময়ে পাঁচজন তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হলেও মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি।
তনুর বাবা ইয়ার হোসেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী। চাকরির সুবাদে সেনানিবাসের কোয়ার্টারে পরিবার নিয়ে থাকেন। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের পাওয়ার হাউসের অদূরের জঙ্গল থেকে তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন তনুর বাবা কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।
শিগগির শুরু হচ্ছে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পুনর্তদন্ত:
বিডিআর বিদ্রোহের সময় ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের পুনর্তদন্ত শুরুর কথা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গত ২ সেপ্টেম্বর তিনি বলেন, শুধু স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে নয়, একজন সাধারণ নাগরিক ও সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য হিসেবে আমি বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার চাই। সঠিকভাবে এ হত্যাকাণ্ডের পুনর্তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু করা হবে।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। এই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। হত্যা মামলার রায় হয়েছে। তবে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন সাজাপ্রাপ্তরা। যেগুলো এখন শুনানির অপেক্ষায়।
অন্যদিকে বিস্ফোরক আইনের মামলায় বিচারকাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম এক প্রকার স্থগিত রেখে শুধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। যে কারণে এই মামলার বিচার ঝুলে যায়।
ক্ষমতার পালাবদলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার তদন্ত পুনরায় শুরুর দাবি উঠছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন, সঠিকভাবে এ হত্যাকাণ্ডের পুনর্তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু করা হবে।